Saturday, 11 November 2017

চার আনার ছইমুদ্দিন: স্মৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

দিন যায়, রাত আসে, সপ্তাহ-মাস-বছর গড়িয়ে যায়। সময়ের স্রোতে আমরা প্রতিনিয়ত ভেসে চলি। এই চলার পথে স্মৃতির পাল্লা ভারি হতে থাকে। হাজারো স্মৃতির ভিড়ে কিছু স্মৃতি শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। তেমনই এক স্মৃতির নক্ষত্রের নাম ছইমুদ্দিন।



কয়েকদিন ধরে বিদেশি একটি স্কুলে কাজের সুবাদে বারবার ছইমুদ্দিনের কথা মনে পড়ছে। এই বিদেশি স্কুলে প্রতিদিন স্যুট-টাই পরা ছেলেমেয়েরা মার্সিডিজ-বিএমডব্লিউ গাড়ি চড়ে আসে। ক্লাসের পর ভেন্ডিং মেশিনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের খাবারের লোভে। এইসব দৃশ্য দেখলেই আমার ছোটবেলার সেই ছইমুদ্দিনের মুখটা ভেসে ওঠে।

আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল বাড়ির কাছেই। মাটির দেওয়ালে ইটের গাঁথুনি, উপরে টিনের ছাউনি। একটাই বড় ঘর, তার ভেতরেই সব ক্লাস। বাড়ি থেকে বস্তা নিয়ে গিয়ে বসতাম। এক কোণে ক্লাস ওয়ান, অন্য কোণে ক্লাস টু। ক্লাসের মাঝেই চলে আসত বড়োরা – ক্লাস থ্রি, ফোর, ফাইভ। জায়গা দখলের জন্য মাঝেমধ্যে হট্টগোল বেঁধে যেত। তবে এইসব হট্টগোল পেরিয়ে দৈনিক সমাবেশের ঠিক আগেই চলে আসত আমাদের প্রিয় ছইমুদ্দিন।

মাথায় গামছার বেড়ি দিয়ে বাঁশের ডালিতে ভরা রকমারি খাবার নিয়ে ছইমুদ্দিন স্কুলে ঢুকত। তার আসার আগেই ছেলেমেয়েরা ছুটে গিয়ে তাকে ঘিরে ধরত। মনে হতো, কোনো বড় নেতা যেন মঞ্চে আসছেন। আমাদের সেই ‘নেতা’ ছইমুদ্দিনের ডালিতে কি ছিল না! বাদাম ভাজা, কাবলি বুট, ভুট্টার খৈ, রসালো বুন্দিয়া, জিলাপি – এক ডালিতে এত কিছু! চার আনার ভুট্টার খৈয়ে আমাদের হাফপ্যান্টের পকেট ভরে যেত।

দশ পয়সা, বিশ পয়সায় অনেক কিছুই কেনা যেত ছইমুদ্দিন কাকার কাছ থেকে। কেউ পাঁচ পয়সা নিয়ে গেলেও খালি হাতে ফিরে আসত না। শুধু আমাদের স্কুল নয়, মহেশপুর থেকে সিদ্দিশি পর্যন্ত সব স্কুলেই ছইমুদ্দিনের ছিল অবাধ বিচরণ। শিশুরা ছিল তার প্রাণ। তিনটি স্কুলে যাওয়ার এই রুটিন যেন তার জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল।

ছইমুদ্দিন ছিল আমাদের ছোটবেলার হিরো। কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি হারিয়ে গেলেন। কোথায় গেলেন, কিভাবে গেলেন, কেউ জানল না। আরো আশ্চর্যের বিষয়, আমরা তাকে খুব দ্রুত ভুলেও গেলাম। সময়ের স্রোতে হাজারো স্মৃতি চাপা পড়ে যায়, কিন্তু কিছু স্মৃতি চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকে। চার আনার সেই ছইমুদ্দিন কাকা আমার স্মৃতির পাতায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

আজ এত বছর পরও, বিদেশি এই চাকচিক্যের মাঝেও, ছইমুদ্দিনের কথা মনে পড়ে। তার সরলতা, তার ভালোবাসা, আর শিশুদের প্রতি তার অগাধ মমতা – এসব যেন সময়ের স্রোতকে উপেক্ষা করে আমার স্মৃতির আকাশে শুকতারা হয়ে জ্বলছে।

No comments:

Post a Comment