Friday, 2 September 2016

শৈশবের যুদ্ধের গল্প থেকে স্নাইপারের কিংবদন্তি ভাসিলি জেইতসিভ পর্যন্ত


শৈশবের যুদ্ধের গল্প থেকে স্নাইপারের কিংবদন্তি ভাসিলি জেইতসিভ পর্যন্ত**  

শৈশবে বাবার কাছে শুনতাম প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আর ভিয়েতনামের যুদ্ধের গল্প। বাবার এই গল্পগুলো রোমাঞ্চে ভরা ছিল, কিন্তু একইসাথে যুদ্ধের বিভীষিকার এক নির্মম ছবি কল্পনায় ফুটিয়ে তুলত। ছোটবেলার একরকমের বিনোদন ছিল এই গল্পগুলো। আর বিনোদনের মাধ্যম বলতে তখন ছিল বাবার জাপানি প্যানাসনিক রেডিও। খবর, নাটক ছাড়াও আমাদের পছন্দের ছিল রেডিও চায়না।  

মাধ্যমিক শেষ করার পর যখন বাড়িতে এলো সাদাকালো নিপ্পন টিভি, তখন বিনোদনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো। টিভিতে এক্স-ফাইলস আর হারকিউলিস দেখা শুরু হলো। এই সিরিজগুলো দেখে মফস্বলের ফুলবাড়ীতে বইয়ের দোকানে খুঁজে বেড়াতাম এ ধরনের গল্প। কোথাও ভিসিআর চললে একশান মুভির পোস্টারের নাম দেখে খাতায় টুকে রাখতাম। তখন থেকেই একশান মুভির প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়। কিন্তু যুদ্ধের সিনেমার প্রতি দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল বাবার রোমাঞ্চকর গল্পগুলো থেকেই।  

সময় গড়াতে গড়াতে হাতে এলো কম্পিউটার। তারপর এক সময় ইন্টারনেট সংযোগের সুবাদে ২য় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিনেমাগুলো দেখতে শুরু করি। ২০১১ সালে এমনই কিছু সিনেমা দেখার মধ্যে *এনিমি অ্যাট দ্য গেটস* আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।  

প্রথমবার সিনেমাটি দেখে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলো যেন কল্পনায় দেখতে পেলাম। এর পরেও সিনেমাটি বারবার দেখা হয়। ততদিনে ২য় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ব্যক্তিগত পড়াশোনাও বেশ এগিয়েছে। জেনেছি স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ, হিটলারের সিক্স আর্মি, আর সোভিয়েতের রেড আর্মির কথা।  

স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ এবং ভাসিলি জেইতসিভের সাহসিকতা  
মানব ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর যুদ্ধ ছিল স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ। ভোলগা নদীর তীরে ১৯৪২-৪৩ সালে এই যুদ্ধ হয়েছিল। সোভিয়েত স্নাইপার ভাসিলি জেইতসিভকে নিয়ে নির্মিত সিনেমা *এনিমি অ্যাট দ্য গেটস* এই যুদ্ধের এক অসাধারণ চিত্রায়ণ। সিনেমার নাম নেওয়া হয়েছে উইলিয়াম ক্রেগের লেখা বই থেকে, যেখানে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।  

সিনেমাটিতে ভাসিলির সাহসিকতার গল্পকেই মূল ভিত্তি করা হয়েছে। এই স্নাইপার রাইফেল হাতে শত্রুদের ঘায়েল করে রেড আর্মির অন্যতম শক্তিতে পরিণত হন। ভাসিলি তার সাধারণ মানের মোসিন-নাগান্ত রাইফেল দিয়ে প্রায় ২৪২ জন প্রতিপক্ষ সেনাকে হত্যা করেন। অনেকের মতে, এই সংখ্যা পাঁচশরও বেশি।  

এনিমি অ্যাট দ্য গেটস সিনেমাটি যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এবং মানবিক বিপর্যয় ফুটিয়ে তুলেছে। তবে বাস্তবের ভাসিলি জেইতসিভের কিংবদন্তি দুই ঘণ্টার কোনো সিনেমায় পুরোপুরি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সিনেমাটিতে দেখানো হয়, কীভাবে সোভিয়েত রেড আর্মি কমরেডদের হাতে পর্যাপ্ত রাইফেল না থাকা সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে যায়। একদিকে লাশের স্তূপ, অন্যদিকে সীমিত গোলাবারুদ নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সোভিয়েত সৈনিকদের দৃশ্য গা শিউরে তোলে।  

জার্মান বাহিনী যখন ভাসিলির স্নাইপার বিগ্রেডের সামনে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন তারা আরেকজন দক্ষ স্নাইপার পাঠায় তাকে হত্যা করতে। শুরু হয় দুই স্নাইপারের মধ্যে ভয়ঙ্কর লড়াই। ভাঙা ভবনের মধ্যে লুকিয়ে থেকে একে অপরকে পরাস্ত করার চেষ্টা যেন টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনের মতো মনে হয়।  
 
যুদ্ধশেষে ভাসিলি রাষ্ট্রীয় বীরের মর্যাদা পান। তার ব্যবহৃত রাইফেলটি এখনো স্তালিনগ্রাদের ঐতিহাসিক জাদুঘরে সংরক্ষিত। সিনেমার শেষাংশে কিছু অতিরঞ্জিত রোমান্সের দিক থাকলেও, পরিচালক জ্যাঁ-জ্যাকস আন্নাউদ যুদ্ধের বিভীষিকাকে সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।  
  
এনিমি অ্যাট দ্য গেটস শুধু একটি সিনেমা নয়; এটি স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের ভয়াবহ ইতিহাসের একটি প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধের এই গল্প হৃদয়কে নাড়া দেয়, বিশেষত যারা ২য় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস এবং ভাসিলির মতো সাহসী যোদ্ধাদের জীবনের প্রতি আগ্রহী।

No comments:

Post a Comment