Saturday, 5 January 2019

ময়নার খোঁজে একদিন রূপনগরে

তৃতীয় কি চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। নব্বই দশকের গোড়ার দিকের কথা। সেই বয়সে গোল্লারছুট, লুকোচুরি ,লাঠিম ঘোরানো ,ঘুড়ি উড়ার চেয়ে পাখিদের ছানা ফোটানোর মৌসুম এলেই আমরা ব্যাস্ত হয়ে পড়তাম, কোন গাছে শালিক পাখি বাসা বেঁধেছে,কোনটাতে পাখির ছানা ফুটেছে। কিন্তু আমাদের বাড়িতে পাখির ছানা গাছ থেকে নিয়ে আসা ছিল নিষিদ্ধ। যতবারই নিয়ে আসতাম বাবা লোকদিয়ে সেগুলোকে আবার রেখে আসতো আর প্রতিবারই বলতো এসব হবেনা।আর বার বার ময়না পাখির ছানা নিয়ে আসার কথা বলতো। ময়না পাখি সেসময় শুধু পড়ার বইতেই শুধু দেখেছি।বাস্তবে ময়না পাখি কখনোই দেখিনি। হটাৎ একদিন খবর এলো পাশের গ্রামে আর্মির বাড়িতে খাগড়াছড়ি থেকে ময়না পাখি এনেছে যা আবার মানুষের মতোই কথা বলে। ছেলেপেলের দলের সাথে আমিও গেলাম ময়না পাখি দেখতে। মানুষের মতোই কথা বলছে ময়না পাখি। একদিন দুদিন প্রায় প্রতিদিনই যেতাম কথা বলা ময়নার কাছে। সেই ছোটবেলা থেকেই ময়নার প্রতি ছিল গভীর টান।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বদলে যায়।ভুলে গেছি ময়না পোষার শখটিও। কিন্তু ছোটবেলার সেই অবচেতন মনের ভিতরে রয়ে যাওয়া শখটি হটাৎ ফিরে আসে একদিন ,যেদিন দাদার বন্ধু দশরথ দা সুনামগঞ্জ থেকে বেড়াতে এসেছিলো। কথাচ্ছলে আমি দশরথ দা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে সেখানে কি ময়না পাখি পাওয়া যায় ?দশরথ দা আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল সেদিনই। মেঘালয় পাহাড় থেকে সে আমার জন্য ময়নার ছানা নিয়ে আসবে। কয়েকমাস পর সত্যি সত্যি আমাকে ফোন দিয়ে সুনামগঞ্জ আসতে বলে।২০১৩ সালের কথা ,আমি তখন স্কয়ার হাসপাতালে চাকরি করছি। দুদিনের ছুটি নিয়ে আমি রওনা দেই সুনামগঞ্জে ময়নার খোঁজে।   ময়নার খোঁজে সুনামগঞ্জে যাওয়ার ঘটনাটি এর আগে আমার আরেকটি ব্লগে লিখেছিলাম সেটিই ঘষে মেঝে কপি করে দিলাম এখানে।

১৫/০৬/২০১৩ আমার যাত্রার তারিখ । সকালে মহাখালী বাস টার্মিনালে থেকে টিকিট কেটে উঠে বসি বাসে । ঢাকার জ্যাম পার হয়ে গাড়ি ছুটছে ময়মনসিং হাইওয়ে দিয়ে ।অচেনা নতুন জায়গা। জানালায় মুখ রেখে ছুটে চলা পরিবেশ প্রকৃতি দেখছি আর ভাবছি সত্যিই কি ময়নার দেখা পাবো ? দুপুর ১:৩০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম সুনামগঞ্জ । বাস থেকে নেমে চলে এলাম কলমাকান্দার বাস স্টপে ।মোবাইলে দশরথ দা সর্বক্ষণ আমাকে দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। একসময় বাধ্য হয়ে দশরথ দা কে বললাম “দাদা আমার রূপনগরের রাস্তা মুখস্থ হয়ে গেছে। আপনি টেনশন নিয়েন না”,আরে বাবা হাতে তো স্মার্ট ফোন আছে। ৩জি ৪জির যুগ তখন শুরু হয়নি। কিন্তু ২জি দিয়েই গুগল ম্যাপস ঠিক বলে দিচ্ছে আমার অবস্থান আর গন্তব্যের দূরত্ত্ব। কলমাকান্দার বাস স্টপে এসেই টিকিট কেটে উঠি লক্কর ঝক্কর মার্কা একটি বাসে।আমাকে যেতে হবে তাড়াতাড়ি কলমাকান্দায়। কেননা ৪ টার পরে আর কোনো ট্রলার বা নৌকা রূপনগরে যাবে না। ২ টার বাস ছুটে চলছে কলমাকান্দার পথে। গাড়ির নিয়মিত যাত্রীরা মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছে আর আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি আষাঢ়ের বিশাল মেঘমালার দিকে। আমার সাথে তারাও যেনো সওয়ার হয়েছে। আমি অবশ্য রূপনগর পর্যন্ত যাবো কিন্তু মেঘেরা আরো দূরে মেঘালয় কিংবা আসামের কোনো পাহাড়ে গিয়ে ঘাঁটি গাড়বে। ভাবতে ভাবতে ঘণ্টা দেড়েক পর আমি বাসের কন্ট্রাক্টর কে জিজ্ঞেস করলাম আর কতদূর ?উনি ঈষৎ হাঁসি দিয়ে জানালো কলমাকান্দায় প্রায় চলে এসেছি। কলমাকান্দায় চলে এসেছি মানে কলমাকান্দা থেকে মেঘালয়ের মেঘ পাহাড়ের খেলা দেখতে পাবো। দশরথ দা তো তাই বলেছে। আমি এবার পাশে বসা একজনকে জিজ্ঞেস করলাম “এখান থেকে কি পাহাড় দেখা যায় ?” তিনি আমাকে সামনের মোড় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। সত্যিই বাসটি মোড় ঘুরতেই মেঘালয়ের অংশ বিশেষ আমার নজরে এলো।

 আমার প্রথম পাহাড় দেখা। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি কলমাকান্দায় চলে আসি। কলমাকান্দায় নেমে রিক্সা নিয়ে ট্রলার ঘাটে আসি।
বেশ কয়েকটি নৌকা বাধা আছে ঘাটে ,আমি এগুলোকেই ট্রলার বলছি। ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে ট্রলারে উঠছে। পড়ন্ত দুপুরে খরতাপে আমি ট্রলারের ছাদেই জায়গা করে নিলাম। এবার ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করি কেননা সামনে আমার বিশাল জল রাশি , আর দূরে মেঘের মত দেখা যায় মেঘালয় পর্বত মালা । জীবনে প্রথম পাহাড় দেখা আর টাঙ্গুর হাওড়ের বিশাল জলরাশির সাথে মেঘ পাহাড়ের মিতালি।
সমুদ্র সমান জলরাশি (তখন পর্যন্ত আমি সমুদ্রও দেখিনি )এডভেঞ্চারের প্রথম স্বাদ নিজেকে সিন্দাবাদ সিন্দাবাদ মনে হচ্ছে। আমি অবাক বিস্ময়ে দেখছি হাওরের বিশালতাকে আর পুচকে ক্যানন দিয়ে কিছুক্ষন পর পর ক্লিক ক্লিক।
ঐযে দূরে, দূরে মৌন দাঁড়িয়ে মেঘের সাথে ছায়া ছায়া মেঘালয় পর্বতমালা।
ট্রলারের যাত্রীরা আমাকে দেখছে। মাঝে মাঝে টুক টাক প্রশ্ন করছে। আমিও টুক টাক উত্তর দিয়ে এখানকার পরিবেশ প্রকৃতি জানবার চেষ্টা করছি।
পড়ন্ত দুপুরের শান্ত বিলের জল । সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক নৌকা …নৌকাতে বোঝাই ক্ষুদ্র বাসায়ীদের বাঁশ দিয়ে তৈরী মাছ ধরার উপকরণ।সামনে বর্ষাকাল তাই মাছ ধরার এই উপকরণ গুলোর দারুন চাহিদা পুরো হাওর অঞ্চলে।
হাওড়ের শান্ত নীল জলের আয়নায় মুখ দেখে নীল ওই দূরের আকাশ।

হাওড়ের মাঝে ছোট ছোট দ্বীপের মতো গ্রাম।এসব গ্রামের লোকদের সাথে হাওড়ের গভীর মিতালি। বাবাকে নৌকাতে নিয়ে লগি মারছে ছেলে।
ছোট ছোট ডিঙি নৌকা গুলোতেও এখন ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। তর তর করে হাওরের জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ডিঙি নৌকা।

হাওড় তার নিজের মতো করে সবাইকে আপন করে নিয়েছে পরম মমতায়।

হাওড় অঞ্চল প্লাবিত হলে অবশ্যইএখানকার প্রধান বাহন নৌকা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও স্বাচ্ছন্দে নৌকা বেয়ে এখানে ওখানে যাওয়া আসা করে।


ছোটো ছোটো দ্বীপের মতো গ্রামের প্রত্যেকের কাছে ছোট নৌকা থাকে। বাড়ীর সামনে বাঁধা ডিঙি নৌকা।



দূরে পাহাড়ের আড়ালে সূর্য্য মুখ লুকায়।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।সাঁতার কেটে হাওরের জল ভেঙে হাঁস ঘরে ফিরছে। পানকৌড়ি সারাদিন ডুব শেষে নলখাগড়ার ঝোপে ঝিমুচ্ছে। প্রায় সাড়ে তিনঘন্টা নৌকাতে বসে হাওড়ের জীবন, প্রকৃতির রং রূপ দেখতে দেখতে গোধূলি বেলায় রূপনগরে চলে আসি।দশরথ দা ঘাটে এসে আগেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কিছু দূরে সন্ধ্যে বেলায় ওনার বাসায় পৌঁছে গেলাম।
পরের দিন সকালে রূপনগরের রূপ দেখতে বের হই। মেঘালয়ের কোলে সুন্দর একটি গ্রাম রূপনগর।পাশেই ভারতীয় সীমান্তে টহলরত ভারতীয় বিএসএফ জওয়ানদের দেখে আমি কোনোমতেই আর সামনে যেতে চাইনা। কিন্তু দশরথ দা আমাকে একপ্রকার টেনে টুনে আমাকে নোমাসলান্ড পর্যন্ত নিয়ে যায়। কোনো কাঁটা তারের বেড়া নেই। রূপনগরের অনেক নারীদের দেখলাম হাতে বস্তা বা ব্যাগ জাতীয় কিছু নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে নোমাসলান্ড পেড়িয়ে পাহাড়ের জঙ্গলে ঢুকে যেতে। জিজ্ঞেস করে জানলাম তারা পাহাড়ে কাঁঠাল জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে। বিনিময়ে বিএসএফ প্রতিজনের কাছ থেকে ২০ টাকা করে নেয়।
রূপনগর ঘোরা শেষ হলে দশরথ দা আমাকে নিয়ে যায় একটি বাড়িতে যেখানে ময়নার ছানা রাখা আছে। ঐদিনই আমি ময়নাকে সাথে করে নিয়ে আসি ঢাকায়।সেও অনেক লুকিয়ে পালিয়ে অনেক কষ্টে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা। সেও এক লম্বা কাহিনী। পরে একদিন তা নিয়ে লিখবো। আপাতত দুদিনের ছুটি শেষ।

No comments:

Post a Comment