'কিরে কই থেকে কুড়লি ,চেয়ারম্যানের সেই শিউলি ফুলের গাছটি এখনো কি আছে ?' তুলি বললো -
'ধুস ঐটা কবেই কেটে ফেলেছে ,এটা আমাদের বাড়ির গাছ। তুলসী তলায় যেটি লাগিয়েছিলাম এই প্রথম ফুল ফুটেছে।সকালে উঠে দেখি তুলসী তলা শিউলিফুলে সাদা হয়ে গেছে। তুমি পুজোয় আসছো তো ?'
'আমি বললাম কবেরে দূর্গা পূজা ?'
'এমা তুমি জানোনা ,গতকাল মহালয় হয়ে গেলো। আমরা সবাই টিভিতে দেখলাম। জানো মেজদাদা মহালয়ায় এবার ষ্টার জলসায় আর জি বাংলায় দূর্গা কে সেজেছে ?......'
ও বলে চলেছে ,আমি লাইন কেটে দিলাম।
এরই মধ্যে শরৎ চুপি চুপি চলে এসেছে টের পাইনি। এই ইট কাঠ পাথরের শহরে সময়গুলো ঠিকই তার নিজের গতিতে চলে যায় ,আমরা কেউ বুঝতেই পারিনা। বাংলাদেশ থেকে সম্পুর্ন্ন ভিন্ন প্রকৃতি মালয়েশিয়ার। সারাবছর একটিই ঋতু। প্রায়ই দেখি বিলাই কুকুরের বৃষ্টি তারপর আবার ফঁকফঁকা। এখানে শারদ আসেনা কাঁশবনে সাদা ফুলের ঢেউ খেলানো বাতাস কিংবা সুরভিত শিউলির গন্ধ নিয়ে। হেমন্ত আসেনা কৃষকের কাস্তে হাতে রোদে পোড়া মুখের এক চিলতে হাসি নিয়ে। ভাঁপা পিঠা পুলির শীতের রাত কিংবা আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে ভ্রমর গুঞ্জরনে আর শিমুল কৃষ্ণচূড়ার লাল হাঁসিতে আসেনা বসন্ত।কিন্তু ঋতু চক্রের আবর্তে ছয় ঋতুর দেশে শারদ তার নিজস্য স্বভাব নিয়ে হাজির আর তার সাথে হাজির বাঙালির চিরন্তন ধর্মীয় উৎসব দূর্গা পূজা।এই উৎসব শুরু হতো মহালয়ার মাধ্যমে।আর মহালয় মানে ছিল শিশির ভেজা ভোরে আকাশবাণী থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কন্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী তথা চন্ডি পাঠ।কতদিন শুনিনি উদাত্ত কন্ঠে সেই চন্ডি পাঠ অথচ এক সময় সারাবছর অপেক্ষা করতাম তার কন্ঠে মহিষাসুর মর্দিনী শুনবো বলে। ভোরবেলা সাড়ে চারটার আগে ঘুম থেকে উঠে বাবার ন্যাশনাল প্যানাসনিক রেডিওতে আকাশবাণী টিউন করে বসে থাকতাম গায়ে চাদর জড়িয়ে মাদুর পেতে। মহালয়া শুরু হলে ফুল ভলিউমে শুনতাম অন্যদেরও শুনাতাম। মূলত এই দিন থেকে শুরু হতো আমাদের দূর্গা পূজার আনন্দ। সেদিন থেকে মা'র কাছে বার বার জানতে চাইতাম কবে পূজার জামা কাপড় কিনতে যাচ্ছি ফুলবাড়ীতে।মা নারিকেল কুরে নাড়ু বানায়,মুড়ি মুড়কি ,মোয়া তৈরিতে ব্যাস্ত থেকেও আমার কথার উত্তর দেয় বলে- 'এইতো পাট বিক্রি হলেই যাবো।' আমাদের আবদার ছিল মা কেন্দ্রিক। বাবা ছিল প্রচন্ড রাগী তাই মা বাবাকেও কোনো কিছু বলতে সাহস পেতো না। বাবার আশেপাশে ঘুরা ঘুরি করলেও টের পেতাম না তার মনের কথা ,ভাবতাম বাবার হয়তো এমনই হয়। মা ছাড়াও আরো দুইজন ছিল যাদের কাছে আমরা ভয়ডরহীন সব কিছু বলতে পারতাম এক প্রবাস জ্যাঠা আর অন্যজন ভজা দা। দুইজনেই আমাদের অনেক পুরোনো কাজের লোক। ভজাদাকে জিজ্ঞেস করতাম-
'পাটের দাম কি বেড়েছে ,কবে আমাদের পাট বিক্রি করতে নিয়ে যাবে ?
ভজা'দা আমাদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া কথা বলতো -
'এবার কোনো পাট বিক্রি হচ্ছে না কেননা পাটের দাম নেই ,তাই এবার আর হাটে পাট নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না।'
আমি বিমর্ষ হয়ে মা দূর্গা কে ডাকতাম। মন প্রাণ দিয়ে ডেকে বলতাম-
'মা দূর্গা পাটের দাম বেড়ে দাও নইলে পুজোর জামা কাপড় কেনা হবেনা ,আর নতুন জামা কাপড় না পরে মামার বাড়িতে পুজো দেখতে কিভাবে যাবো ?ময়নাদি,হাসি,পাপ্পু,পঞ্চম,কেয়া ওরা কত সুন্দর সুন্দর পুজোর জামা পরে ঘুরবে আর আমি ?
মা দূর্গা প্রতি বছর আমার কথা শুনতো। পাটের দাম বাড়ুক আর না বাড়ুক প্রতি বছর ঠিকই আমাদের পাট বিক্রি হতো। রাতে ডিসপেনসারি থেকে বাবা ,প্রবাস জ্যাঠা,ভজা দা একসাথে ফিরলে শুরু হতো পাট মাপা। হারিকেন জ্বালিয়ে পাট মেপে মেপে সেগুলোকে সুন্দর করে ভাঁজ করে বাধা হতো।মাপামাপি শেষ হলে প্রবাস জেঠা গরুর গাড়ির চাকা লাগিয়ে ঠিক থাকে করে রেখে চলে যেত। ভোরবেলা অন্ধকার থাকতেই বাবা আর প্রবাস জ্যাঠা রওনা দিতো হাটে। পরেরদিন বাবা আমাদের নিয়ে যেত জামা কাপড় কিনতে। সবার জন্য একসেট জামাকাপড় কিনলেও বাবা কখনোও নিজের জন্য কিনতো না।আমাদের গ্রামের আশেপাশে কোথাও পূজা হতোনা। তাই আমাদের পূজা ছিল মামাবাড়ি কেন্দ্রিক। যেদিন চার পুত্র-কন্যা নিয়ে হিমালয় থেকে পিতৃলোকে মর্ত্যে গমন করে দেবী দূর্গা ঠিক তখন আমার মা'ও আমাদের কে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে রওনা দিতো।দেবী দুর্গার মতো চারটি বাহন ছিলোনা, বাহন বলতে মামা বাড়িতে যাওয়ার একটিই পথ ছিল সহজ তা হচ্ছে দুই মাঝি আলা ছৈয়ের নৌকা। স্রোতস্বিনী ছোট যমুনার স্রোতের বিপরীতে সারাদিন দাঁড় বেয়ে চলত সেই নৌকা। আমি বড় বড় চোখে নদীর দুই পারে সাদা কাশফুলের বন ,ঘন জঙ্গল আখ ক্ষেত,জেলেদের ডিঙি নৌকায় মাছ ধরা ,নদীর পারে ছোট ছোট গ্রামের দুরন্ত ছেলেমেয়েদের উঁচু পার থেকে লাফিয়ে পড়া আর দূর কোনো গ্রামের পুজো মন্ডপ থেকে ভেসে আসা ঢাকের শব্দ শুনতে শুনতে সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে যাই গোপালপুর মামা বাড়িতে।নৌকা থেকে নেমেই দৌড়ে যেতাম পূজা মন্ডপে। সাদামাটা সেই পূজা মন্ডপ রঙিন কাগজ আর বাহারি বেলুন দিয়ে সাজানো টিনের ছাপড়ার সেই মন্দির আলোকিত হতো হ্যাজাক কিংবা জেনারেটরের আলোয়। স্মৃতির সেই পূজা এখনকার লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যায়ে সেই পুজোকে ম্লান করতে পারেনি কখনোই ।