Monday, 22 August 2016

তিলোত্তমা তাল

আজকেও বাড়ি থেকে ফোন এলো প্রতিদিনের মতো। কিন্তু তুলি আজকে বেশ উচ্ছাসিত।আমাকে ফোন দিয়ে বলে ''মেজদাদা জানো আমি কি করছি?'' আমি বললাম ''কি করছিস?'' সে বলে আমি ''তাল ছেঁকে রস করছি। মা বলেছে তালের রস করে কাঁচের বয়ামে ভরে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিতে তোমার জন্য।'' যেহেতু ও একটু বেশি আনন্দিত সেহেতু আমি আরো একটু বেশি আনন্দিত হওয়ার অভিনয় করে জানতে চাইলাম তা কয়টা এনেছে ,কত হলো দাম ইত্যাদি ইত্যাদি তারপর  মা'র সাথে দুটি কথা বলে রেখে দিলাম। দেখতে পাচ্ছি মা'র চোখে চক চকে আনন্দ একটু পরেই চিক চিক করছে জলে দুই চোখ। অতি উৎসাহ নিয়ে তাল ছেকে থক থকে রস করে সেগুলোকে বয়ামে ভরে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিচ্ছে। আমি কবে আসবো সেই অপেক্ষায়।সময়ের সাথে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ইট কাঠ পাথুরে শহরে এসে  হয়েছে আমাদেরও পরিবর্তন। কিন্তু বাবা-মা'রা?
 আজকাল পাকা তাল পাওয়া যায়না।এখানে ওখানে যদিও দুই একটি গাছ আছে সেগুলোর মালিকেরা পাকা তালের আশায় আর থাকে না। শহর থেকে লোক এসে কাঁচা তালের কাদি কিনে নেয়। তারপর সেগুলো শহরের অলি গলিতে শাঁস বিক্রি করে। তাই পাকা তাল পাওয়ার বিষয়টি আমাদের এলাকায় কিছুটা বড় ইলিশ মাছ পাওয়ার মতো ঘটনা বৈকি। অন্যদিকে আমাদের কিশোর বয়সে আম কুড়োনো আর তাল কুড়োনো নিয়ে মজার মজার ঘটনার মধ্যে তাল কুড়োনো ছিলো অন্যন্য। বাবার কড়া শাসনে আমরা কেউ কিছু করতে পারতাম না। যা করতাম তা লুকিয়ে লুকিয়ে। আর তালতলায় যাওয়া ছিল নিষেধ নাম্বার ওয়ানে। বাড়ি থেকে গ্রামের তালতলা খুব বেশি দূরে না। সরকার পট্টির পুকুরপাড় দিয়ে শ খানেক তালগাছ। প্রত্যেকটি তাল গাছ ভিন্ন ভিন্ন নামে, কেননা ভিন্ন ভিন্ন স্বাধ,গন্ধ আর বিভিন্ন আকারের তালের জন্য একেকটি গাছ একটি নাম ডাকা হতো। যেমন ক্ষিরসাপাতি গাছ ,হ্যাড়া গাছ, দুধ সাগর গাছ। দিনে ছেলেপেলেদের দল থাকতো তালতলায়। আমাদের তাল পাওয়ার কোনো চান্স থাকতো না  তাদের ভিড়ে তবুও মাঝে মাঝে যেতাম।একবার দাদা আমি প্ল্যান বের করি রাতে চুপি চুপি তাল কুড়োতে যাবো। কিন্তু রাতের বেলায় ছেলেরা মশাল জ্বালিয়ে সারারাত তালতলায় আড্ডা মারে। আমরা সুযোগ খুঁজতে থাকলাম। বেশ কিছুদিন বৃষ্টি নেই ভাদ্র মাসের গনগনে রোদ্র ভ্যাপসা গরমে সবাই যখন অতিষ্ঠ তখন আমরা দুজনে বেশ ফুর ফুরে কেননা যেকোনো সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামবে আর এই গরমে সব পাকা তালের বোটা নরম হয়ে থপ থপ করে ঝরে  পড়বে।সত্যি সত্যি একদিন  বিকেল থেকে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির তোপে ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস দুজনের কারোরই হলোনা। আমরা অপেক্ষা করছি বৃষ্টি থামার জন্য। মাঝ রাতে  বৃষ্টির তেজ কমতেই একটি বস্তা লাঠি আর টর্চ নিয়ে পেছন দরজা দিয়ে সোজা চলে গেলাম তালতলায়। টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তালতলায় টর্চ জ্বালিয়ে তালের সংখ্যা দেখে আমরা কিছুটা ভড়কে গেলাম। মাত্র একটি বস্তা কিন্তু তালের সংখ্যা পাঁচগুণ। কয়েকদিনের ভ্যাপসা গরমে হটাৎ প্রবল বর্ষণে তাল কুড়োনীরা তখন ঘুমের দেশে আর আমরা দুজন ধীরে সুস্থে বেছে বেছে তাল একটা বস্তায় পুরে আর কিছু তাল অন্যত্র সরিয়ে রাখলাম পরে এসে নেওয়ার জন্য। পরেরদিন সেই তাল দেখি মা আশেপাশের সবাইকে বিতরণ করছে। এরকম তাল নিয়ে অনেক তেলেসমাতি হয়েছে সেসব এখন পুরোনো। মা হয়তো এসবের স্মৃতি চারণ করছে আর  তালের রস করে বয়ামে ভরে ফ্রিজে রাখছে আমাদের জন্য।শুধু কি তাল ? আম কাঁঠাল ছোট মাছ এমনকি আমার প্রিয় গিমা শাক (এক ধরনের তিতকুটে শাক ) পর্যন্ত ফ্রিজে রেখে দেয় হটাৎ করে যদি আমি আসি বাড়িতে ।প্রত্যেকদিন ফোনে কথা হচ্ছে। অনেক প্রশ্নের ভিড়ে একটা কমন প্রশ্ন থাকবেই ,''কবে আসবি ''? ঘুরে ফিরে ''এইতো মনে হয় সামনের মাসে'' এই একটি উত্তর নানান ভাবে দেই।আর যখন ধরা গলায় বলে ''এই নবান্নে তোরা তিনজনেই মানে দাদা আমি জয়  চলে আসিস'' তখন সত্যি সত্যিই আমার তালগোল হয়ে যায় সবি।

প্রচন্ড শীতে পুরোনো ঘুপচি ঘরে তাল দিয়ে নানা পদের পিঠা তৈরী করছে মা। গত বছর ১৫.০১.২০১৬ তে তোলা ছবি।






No comments:

Post a Comment