ও বলে দাড়া দেখছি।
![]() |
photo: pinterest Audubon California |
গতবছরে তিনটি ছানা দিয়েছিলো তার মধ্যে দুটিকে, আমাদের বাড়ির কাজের ছেলে খগেন পাচার করেছিল আর অপরটিকে নিতে গিয়ে কালুর সাথে আমাদের দুজনের বেশ ফাইট করতে হয়েছিল। কালুও আমাদের সমবয়সী কিন্তু ভয় শুধু ওর মাকেই। কোনোকিছু হলেই তার মা, আমার বাবার কাছে গিয়ে নালিশ করত। আর বাবা ছিল আমাদের কাছে বড় দুর্বলতা। প্রচন্ড শাসনে আমাদের রাখতো।প্রথম কালুর সাথে ঐ শালিক নিয়ে মারামারি তারপর পাকুড় গাছের নিচে ছোট গর্তটির জল ছেচে মাছ ধরা নিয়ে মারামারি।এরকম ঝামেলা লেগেই থাকতো। আমি বললাম,
চল এখন থেকে চলে যাই না হলে কালু দেখে ফেললে এবারও শালিক ছানা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই কালু হুংকার ছেড়ে সামনে এসে বলে
'ঐ ওটা মুই দেকিচো তোমার আগে। ঐ বাচ্চাটা মোর।
কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি হাতের লাঠিমের নতুন শান দেওয়া ছুঁচালো আলটি হাতের মুঠোয় শক্ত করে বাগিয়ে ধরলাম। আবারো আমাদের তৃতীয়বার ফাইট শুরু হতে যাচ্ছে। তাইনা দেখে কালু তড়িৎ গতিতে দু পা পিছনে সরেই রাস্তার পাশ থেকে মোটা একটি নতকুলুম মট করে ভেঙে প্রথম পজিশনে দাঁড়িয়ে আমাদের দুভাইকে ফাইট করার জন্য আহবান জানায়। গত বারের মাছ মারা নিয়ে মারামারির প্রতিশোধ তোলার সুযোগ কোনো ক্রমেই হাত ছাড়া করতে নারাজ সে। এরি মধ্যে খগেন কে আসা দেখে দাদার সাহস বেড়ে গেলো আর আমি কালু কে অচমকা ধাক্কা মারি।আমাদের তৃতীয় বারের কালুর সাথে ফাইট কিন্তু আর এগুতে দিলোনা খগেন।রাতে ভয়ে ভয়ে আছি যদি বাবার কানে যায় তাহলে আর রক্ষে নেই। ভালোই ভালোই রাত পর হতেই পরেরদিন আমরা ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম শালিক ছানার জন্য খাঁচা তৈরির জন্য।আমাদের বাসায় অনেক কাজের লোক। প্রবাস জ্যাঠা জমিজমা দেখে,ভজা দা বাজার খরচ আর খগেন দেখে সব গরুবাছুর। খগেনকে বলে লাভ নেই তাই ভজা দা কে বলতেই ভজা দা আমাদের কে আশ্বাস দেয় বাঁশ দিয়ে নতুন খাঁচা তৈরী করে সে এনে দিবে। তিনটি কাঁচের বোতল পরিষ্কার করে দাদা আমার হাতে দিয়ে ছিপি গুলো ফুটো করে নিতে বলে। ছিপিগুলো আমি জলাই (আলপিন) দিয়ে ছোট ছোট ছিদ্র করি বাতাস চলাচলের জন্য, যাতে শালিক ছানাকে খাওয়ানোর জন্য ফড়িংগুলো জীবিত থাকে।এই বোতল খগেনের জন্য দুইটি আর আমরা দুইজনে একটি। ওকে দিয়ে আমরা আশাবাদী একটু বেশি। কেননা যখন গরু নিয়ে ও মাঠে যাবে তখন শালিকের জন্য সব ফড়িং ধরে নিয়ে আসবে।আমাদের মোটামুটি প্রুস্তুতি শেষ। কয়েকদিন পর আমাদের হাতে শালিক ছানা আসবে তাই উত্তেজনা উৎকন্ঠায় মার্বেলের কৌটা, বিয়ারিংয়ের গাড়ি,কাট কেটে বানানো লাঠিম, ঘুড়ি ,বাহারি ম্যাচের বাক্সের প্যাকেট কেটে বানানো তাস সব খেলনার উপকরণ চৌকির নিচে বস্তা বন্দি করে রাখি।দুইজনে পালা করে লক্ষ্য রাখছি আবার যাতে কালু কোনো ক্রমেই এই ছানাটিকে না নিতে পারে। তারপর একদিন চুপি চুপি শালিক ছানা কে বাসায় নিয়ে আসি।খগেন রোজ মাঠ থেকে বড় বড় ফড়িং ধরে নিয়ে আসে বিনিময়ে ওকে আমার ফুলতোলা মার্বেল গুলো দিতে হয়। মার্বেল দিতে দিতে সব শেষ হয়ে এলো। তারপর দাদার লাঠিম চলে গেলো ,আমার বিয়ারিংয়ের গাড়ির তিনটি চাকা খুলে দিয়ে দিলাম।আমার সমস্ত খেলনা সামগ্রী দিয়ে শালিক ছানার জন্য ফড়িং এর যোগান দিচ্ছিলো খগেন। আস্তে আস্তে ছানাটি বড় হলো। রেশমি পালকের ডানায় যখন জোর এলো ততদিনে বাবাও কিন্তু শালিক ছানার জন্য বাজার থেকে পারুটি আর লাল পাকা মরিচ কেনা শুরু করেছে। ওকে খাঁচায় শুধু রাতে রাখতাম যাতে বিড়াল এসে না ধরে। ছানাটি কে আমরা শুধু শিস দেওয়া শিখিয়েছিলাম। মা কখনোই বন্দি করে রাখতে দিতো না যার ফলে ও মুক্ত হয়েই বেড়াতো। খুব আয়েশি ভঙ্গিতে আমাদের বাড়ির সব জায়গায় চলাফেরা করতো।হটাৎ, একদিন উধাও হয়ে যায় পাখিটি।চারিদিকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনো খোঁজ পাওয়া গেলোনা।আমরা শালিক হারানোর শোকে খাওয়া দাওয়া একপ্রকার বন্ধ করেই দেই। আমার আর দাদার শোক কাটানোর জন্য বাবা আমাদের জন্য নতুন ব্যাডমিন্টন আর নেট নিয়ে এলো। আস্তে আস্তে শোক কেটে ভুলেই গেলাম শালিক পাখির ছানার কথা। প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস পরের কথা। একদিন বিকেলে দাদাকে নিয়ে ঘুড়ি বানাচ্ছিলাম ঠিক সেই সময় আমাদের সামনে উড়ে এলো হারিয়ে যাওয়া শালিক ছানাটি। আমি কাছে যেতেই সে উড়ে গিয়ে টিনের চালে বসে বিচিত্র ভাবে কর্কশে আওয়াজ করছিলো।আমাদের প্রিয় শালিক যে শুধু সিটি বাজাতো সে এখন কাক সহ বিভিন্ন পাখির কন্ঠ নকল করছে থেকে থেকে সেই কালুর কন্ঠ খস খসে বাজখাই আওয়াজ করছে। একই জায়গায় বসে এমন অদ্ভুত আচরন করছিলো।কিন্তু বেশিক্ষন না।পাশের বাড়ির কৌশিকদের হুলোটা আচমকা তাকে আক্রমন করে। চোখের পলকে শালিকটিকে ছিন্ন বিচ্ছন্ন করে দেয়। কয়েক ফোটা রক্ত কয়েকটা পালক আর একটা ডানার কিছু অংশ মাটিতে ঘুরতে ঘুরতে পরে।মনটা আবারো ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। এতদিন আমাদের বাড়ির পাশেই সেই কালুই যে পাখিটিকে বন্দি করে রেখেছিলো আর তাকে কর্কশে শব্দ শিখিয়েছিলো, কখনোই তা ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি কেউ ।এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। সত্যি সত্যিই ভুলে গেছি আমাদের সেই শালিক পাখির কথা।এতো ব্যাস্ততার ভিড়ে ছেলেবেলার ফিকে হয়ে আসা স্মৃতি গুলো যে আবারো নতুন হয়ে আসবে তা কল্পনাতেও ভাবিনি। কয়েকদিন থেকে খবরের খবরের কাগজে একই রকম নিরুদ্দেশের খবর,ব্রেন ওয়াশ করার খবর ইত্যাদি পড়তে পড়তে হঠাৎই আমার সেই শালিক পাখির ঘটনাটি মনে পরে গেলো নতুন করে । পাশে থেকেও নিরুদ্দেশ ঠিক যেমনটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেই কালুরাই এখনকার নতুন কালু যারা গোটাবিশ্বেই মূর্তিমান আতংকের নাম।
No comments:
Post a Comment